golpoআড়ালে তুমি

আড়ালে তুমি পর্ব -(২৬+২৭)

#আড়ালে_তুমি

#সামিয়া_সারা

#কাজিন_রিলেটেড_গল্প

পর্ব -২৬+২৭

সকাল সকাল এলাকাবাসীরা এসে হাজির হয়েছে রিফাতের কাছে। ঘুম থেকে উঠে রিফাত রীতিমতো হতবাক।

সবাই মিলে বলতে শুরু করেছে,

-আয়শার হউর বাড়ির একটা পোলা আইছে না কাইলগো, সুন্দার দ্যাখতে,ঐ পোলাডার অবস্থা বেশি ভালো না,ঈদগাহ -এর হোমকে রক্তে মাইক্কা পইড়া রইছে!

আরেকজন আবার তাকে থামিয়ে বললেন,

-ওই যে লম্ফা হইরা জম্মের ফর্সা মতোন..? হেরে হাসপাতালে নেওয়া লাগবে। নাইলে হে বাচপে না….

নীল,ইনায়া,আনায়া বেরিয়ে এসেছে। আনায়ার মাথায় কিছুই ঢুকছে না ওরা কী বলছে। তবে ইনায়া কিছু টা বোঝে। মানে আনানের অবস্থা খারাপ। ইনায়া হাত মোচড়াতে লাগলো। আতঙ্কে তার অবস্থা খারাপ। আনায়া ঠেলা দিয়ে ইনায়া কে বলল,

-কী বলছে ইনুপু? কীসের হাসপাতাল?

-আমিও বুঝতে পারছি না অনু্।

নীলের কানে কথা গুলো ঢুকতেই রিফাতকে ধাক্কা মেরে ঘরের মধ্যে ঢোকায়। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বলে,

-বাইক বের কর রানিং! চাবি দে আমাকে।

রিফাত টেবিল থেকে চাবি নিয়ে নীলের হাতে দেয়। নীল এক ঝটকায় চাবি ছিনিয়ে বেরিয়ে বাইকে উঠে। রিফাত ও পেছনে এসে বসে সাথে সাথে। নীল দ্রুত বাইক স্টার্ট দেয়। ইনায়ার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে,চোখের পানি কোনো রকমে আটকে রেখেছে। আনায়াকে নাহলে শান্ত রাখা যাবে না।

.

.

.

আনানের নিথর দেহ পড়ে রয়েছে মোড়ের পাকা রাস্তায়। নীল বাইক থেকে নেমে দৌঁড়ে সেদিকে যায়। আনানের মাথা তুলে নিজের কোলের উপর নেয়। গালে হাত রেখে দু বার ডাক দেয়,

-আনান! এই আনান!

আনান অচেতন। লম্বায় আনান আর নীল প্রায় সমান। আবার দৈহিক গঠনও কাছাকাছি। সুঠামদেহী। নীল রিফাতকে ডাকলো কাছে।আনানকে তুলতে তাকে সাহায্য করতে বলল। কোনো রকমে আনানকে নিয়ে সিএনজি তে তোলে নীল। রিফাত বাইক নিয়ে তাদের পেছন পেছন আসে। হসপিটালে এনে ইমার্জেন্সী ডক্টর কল করে। আনানের বেশ র*ক্ত ক্ষরণ হয়েছে। পাশাপাশি ঘাড়ে আঘাত লাগায় জ্ঞান নেই। ডক্টররা আনানকে অ্যাডমিট করে,দ্রুত স্যালাইন দিয়ে র*ক্ত ম্যানেজ করতে বলে। আনানের র*ক্তের গ্রুপ বি নেগেটিভ। এই র*ক্ত এখন কীভাবে জোগাড় করবে নীল। নীলের যে ও পজিটিভ। নীল মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো খামচে ধরলো। ঘেমে উজ্জ্বল শ্যামলা মুখটার মধ্যে তামাটে ভাব এসেছে। চোখের কোণে হাত দিয়ে রিফাতের কাছে গিয়ে বলল,

-তোর র*ক্তের গ্রুপ কী?

-বি পজিটিভ…

-বি নেগেটিভ র*ক্তের গ্রুপ ম্যানেজ করে দে রিফাত! As soon as possible!

রিফাত মাথা নাড়ালো। ভার্সিটির গ্রুপে পোস্ট করে সাথে সাথে। কয়েকজনকে কলও করে। কাছের মানুষদের সকলেই তাকে বলে এই গ্রুপ এর র*ক্ত তো নেই। আর বাকি মানুষেরা ফোন তোলে না। মূলত পার্টির সবার সাথে ঝামেলা হলো গতকাল যারা রিফাতের বন্ধু ছিল। তাই সাহায্যকারীর সংখ্যা কম এখন। রিফাত আশাহত হয়ে নীলের সামনে দাঁড়ায়। দৃষ্টি ফ্লোরে রেখে বলে,

-ভাই পেলাম না।

নীল জবাব দেয় না। কী করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। ব্লাড ব্যাংকেও খোঁজ করেছিল। তবে লাভ হয়নি।

রিফাত কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলে,

-ভাইয়া…

-বল..

-ইনায়া এখন যে খুব ছোট তার নয়। আনানের জীবন টা…

-আমি ভাবছি রিফাত। আমার ইনু পাখিকে ছাড়া উপায় নেই। আমি ওকে নিয়ে আসছি রিফাত। তুই একেবারে আনানকে চোখে চোখে রাখবি। ওর যেন কোনো অসুবিধা না হয়।

কথা গুলো বলতে বলতে নীল চলে যায় বাইক নিয়ে। বাড়িতে তাড়াহুড়ো করে ঢুকে কোনো রকমে ইনায়াকে নিয়ে বেরিয়ে আসে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। আর আনায়াকে ইনায়ার মামিদের কাছে রেখে আসে। ইনায়া একের পর এক প্রশ্ন করেই চলেছে।

-কী হয়েছে নীল ভাই? আনান ভাইয়া কোথায়? কেমন আছে?

নীলের কানে কিছুই ঢুকছে না। কোনো জবাব দেয় না সে। ছোট ভাই এর এমন অবস্থা,তার উপর আবার র*ক্ত তার ইনুর থেকে নিতে হবে। সব এলোমেলো লাগছে নীলের। হসপিটালে যেতেই ইনায়াকে দেখে রিফাত এগিয়ে আসে।

বলে,

-আনানের অবস্থা খারাপ। র*ক্ত দিতে হবে,জ্ঞান নেই।

ইনায়া কান্না করে দেয় এবার। ফুঁপিয়ে উঠলো সে। বলল,

-আমার আর ভাইয়ার রক্তের গ্রুপ এক। আ…আমি দিব..

নীল কপালে তর্জনী আর বৃদ্ধা আঙ্গুল ঠেকায়। ঢাকায় থাকলে মুহুর্তে সব ম্যানেজ করে ফেলতো সে। এখনো হেলিকপ্টার এনে আনানকে নিয়ে যেতে পারতো। নীল এখানেই থাকার মতো এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়াতে নিজেকে অপরাধী মনে করতে থাকে। ইনায়াকে সাথে নিয়ে আনানের কেবিনে যায়। যাওয়ার আগে রিফাতের হাতে হাজার খানেক টাকা দিয়ে বলল,

-দুটো সিদ্ধ ডিম,চারটা ডালিম,চারটা বিটরুট,এক লিটার পানি,দুটো স্যালাইন এর প্যাকেট নিয়ে আয় জলদি গিয়ে। আর এক্সট্রা করে আরো এক লিটার পানি আন। সাথে একটা চাকু..

আনান চমকে তাকায়। নীল শান্ত করে বলে,

-ডালিম খাওয়ার জন্যে। ওয়ান টাইম প্লেটও আনিস।

রিফাত টাকা নেয় না। তবে নীল জোড় করে হাতে গুজে দেয়। বলে,

-যা তুই।

রিফাত টাকা টা বাধ্য হয়ে নিয়ে বেরিয়ে যায়। ইনায়া আনানের পাশাপাশি বেডে শুয়ে রয়েছে। প্রথম বার র*ক্ত দিচ্ছে। অনেক ভয় পেলেও আজ আনানের জন্য যেমন ভয় লাগছে তার কাছে ব্যাথার ভয় কিছুই না। নীল ইনায়ার পাশে বসতেই ইনায়া নীলের হাত শক্ত করে ধরল। নীল আরেক হাত নিয়ে ইনায়ার হাতের উপর রাখে। তারপর আলতো করে কপালে হাত দিয়ে বলল,

-কিচ্ছু হবে না….আমার দিকে তাকা ইনু…

ইনায়া নীলকে দেখে। কী গভীরতা চোখের মধ্যে। কী সুন্দর সরু নাক। ইনায়া তাকিয়ে থাকে একধ্যানে।ইনায়ার নাকের ডগা লাল হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ নেয় নীলের।নীল ইনায়ার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর ইনায়ার দিকে তাকিয়ে মায়াভরা কণ্ঠে ডাক দেয়,

-ইনু

ইনায়ার যেন মাত্র হুস ফেরে। সাড়া দেয় নীলের ডাকে,

-হু…

-কষ্ট হচ্ছে?

ইনায়া ভ্রু ভাজ করে হাতের দিকে তাকালো। এক ঝলক হাতের দিকে তাকিয়েই নীলের দিকে তাকালো। বিড়বিড় করে বলল,

-এতোকিছু কখন হলো?

-কী হয়েছে?

-আপনি ম্যাজিক জানেন?

এতো ঝামেলা চাপের মধ্যেও নীলের মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠলো। মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো সে। ইনায়ার হাতের উপরে নীলের হাত। ডান হাতে ক্যানুলা দেওয়া। বাম হাত নীল ধরে রেখেছে। গতকালও নীল এই হাত ধরেছিল। ইনায়া একটু পরপর হাত ধরেছিল আর মুচকি হেসেছিল সারারাত ধরে। এখন আবার একই ভাবে ধরে রাখা দেখে ইনায়া মুচকি হাসে। নীল কপালে ভাঁজ করে প্রশ্ন করল,

-হাসছিস কেন?

-কী করলে আপনি এই হাত ছাড়বেন না?

-মানে কী?

-কাল থেকে এই হাতে আমি পানি লাগাইনি।

-কেন?

-গত রাতে এই হাতই ধরেছিলেন। তাই আমি আর কাউকে ধরতে দেইনি। এমনকি বাথরুমেও যাইনি।যেন হাত ধুতে না হয়…

নীল চোখ বড় করে ইনায়ার দিকে তাকালো। আচমকা এমন কথা শুনে দাঁত চেপে বলল,

-লাগাম টান! অসুস্থ ভাইকে পাশে অচেতন অবস্থায় রেখে প্রেমালাপ করছিস?

ইনায়া আনানকে দেখে। কিছু একটা ভেবে মায়া হয় তার। মুহুর্তেই মন খারাপ করে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে।

.

.

.

.

নীলের আদেশমতো রিফাত সব রেডি করে রেখেছে। এক্সট্রা করেও আরো অনেক কিছুই এনেছে। র*ক্ত দেওয়া শেষ হতেই নীল ওয়ান টাইম গ্লাসে পানি ঢালে। টিস্যু দিয়ে পেঁচিয়ে সিদ্ধ ডিম হাতে ধরিয়ে দেয় ইনায়ার। গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ করে,

-দেরি করবি না, দ্রুত খাবি।

ইনায়া বেড থেকে নামতে গেলে নীল আবার বসিয়ে বলে,

-খবরদার ইনু! নড়বি না। এভাবেই থাকবি। আর যা যা দিব খাবি এখন।

ইনায়া চোখ টিপ টিপ করে নীল কে দেখলো। তারপর ঠোঁট উল্টিয়ে জিজ্ঞেস করে

-ভাইয়া সুস্থ হবে কখন?

-খুব দ্রুত ইনশাআল্লাহ। বাসায় জানানোর দরকার নেই কিছু।

-কেন?

-জানানো গেলে আমি ওকে ঢাকায় নিয়ে যেতাম ।রিস্ক নিয়ে এখানেই ভর্তি করেছি যাতে কেউ কিছু না জানে।

-এখানেও তো খারাপ না নীল ভাই…

-খারাপ বলতে তুই যা বুঝিস আমি তার বুঝাইনি। হসপিটালে কেউ ভর্তি হলে সবচেয়ে বেশি কী দরকার জানিস? জনবল,পাশে পাওয়া কাছের মানুষদের,পরিচিতি দরকার হয়। নাহলে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। আর এখানে আমার কাছে এর কোনোটাই নেই।

ইনায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো নীলের কথা তে। প্রশ্ন করল,

-তাহলে বাড়ি ফিরবো কবে?

-আমি সাথে থাকতে বাড়ি ফেরার তাড়া কেন? যখন ছিলাম না তখন তো এই প্রশ্ন মাথায় আসেনি।

-আপনি সাথে থাকলে তো আমি..

-কথা বন্ধ! তোর এসব আউল ফাউল কথা তে আমি বিরক্ত হচ্ছি। খেয়ে নে চুপ চাপ।

ইনায়া মুখ ভার করে ফেলে। আশে পাশে হাতরে ফোন খোঁজে। ইনায়ার এমন হাবভাব লক্ষ্য করে নীল প্রশ্ন করল,

-কিছু লাগবে?

-আমার ফোন……

-চার্জ নেই নাকি! দিয়েছিলি?

-ওহ্ শিট্! বাদ দেন,লাগবে না।

-আমার টা নে

বলে নীল তার ফোন ইনায়ার দিকে এগিয়ে দেয়। ইনায়া সাথে সাথে ফোনটা নিয়ে নেয়। তার মনে হচ্ছে সোনার হরিণ পেয়ে গেছে। স্ক্রিন অন করেই নীল কে বলে,

-পাসওয়ার্ড?

-462921

-একি অদ্ভুত পাসওয়ার্ড! মনে রাখেন কী করে?

-বুদ্ধি থাকলে বুঝতি! গাঁধীর মতো আমায় জিজ্ঞেস করতে হতো না।

ইনায়া সন্দেহের দৃষ্টিতে নীলকে দেখে। পাসওয়ার্ড টা মাথায় প্যাঁচ লাগিয়ে দিল। হাতে হাতে গুনতে শুরু করে,

-4 মানে হলো D, 6 মানে F, 2 মানে B, 9 মানে..

-এতোটুকু মাথা নিয়ে আর কিছু ভেবো না । পা*গলি হয়ে একটু পরেই আবার বলবে dfbgba আমার বউ এর নাম! তারপর তোমায় নিয়ে পাবনা রেখে আসতে হবে। দেওয়ান বাড়ির বড়..

-থামলেন কেন? দেওয়ান বাড়ির বড় বউ?

গম্ভীর মুখে তাকালো নীল। বলল,

-বড় মেয়ে। বউ বউ করিস কেন! আর যেন না শুনি। যাই হোক একটু পরে বলিস না আবার যে dfbgba আমার বউ এর নাম।

ইনায়া মাথা চুলকায়। মনে মনে ভাবে,

-তাই ই হবে হয়তো। মনে হয় নাম উল্টো পাল্টা করে লিখা,যাতে কেউ না বোঝে।

সবগুলো অক্ষর একত্রিত করে নাম সাজাতে ব্যস্ত ইনায়া।

বিড়বিড় করে বলতে থাকে,

-Dafbgb,fagbbd,gadbf…..

.

.

.

আনানের জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ হলো। নীল আনান দুজন মুখোমুখি। তবে কারো মুখে কোনো কথা নেই । আনান নীলের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারে ভাই এর উপর কেমন চাপ পড়েছে। আর নীলের চোখ যেন আনানকে বলছে,

-আমার জিনিসে আমার থেকে বেশি তোর টান থাকতেই পারে না আনান!

তবে কেউ কাউকে কিছুই বলে না। আনান পাশের বেডে ইনায়াকে দেখে প্রশ্ন করে,

-তোর কী হয়েছে ইনু?

-তোমায় র*ক্ত দিলাম ভাইয়া! জীবনে প্রথম বার দিলাম।

আনান কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। চকচক করতে থাকা চোখে ইনায়াকে দেখল।

বলল,

-আমাদের কতো মিল ইনু…

নীল আনানের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সাথে সাথে জবাব দেয়,

-ভাই বোনের মিল থাকবেই! র*ক্তের সম্পর্ক তো,তাই র*ক্তের গ্রুপ ও এক। ঘুমা এখন।

ইনায়া শুনে অনেক খুশি হয়। ভাইয়া ভাইয়া করে ফেনা তুলে ফেলা মেয়েটার দিকে আনান হতাশ হয়ে তাকালো। সেদিকে এখন ঝলক দেখে চোখ বন্ধ করে নেয় আনান।

(পাসওয়ার্ড টার অর্থ কি আপনারা ধরতে পেরেছেন? গল্পটা অনেক স্পেশাল,আমি সাধারনত প্লান করে কাজ করি না। তবে এটা নিয়ে পরিকল্পনা অনেক বড়। আপনারা সব কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকবেন🥰💖)

(চলবে……)

#আড়ালে_তুমি

#সামিয়া_সারা

#কাজিন_রিলেটেড_গল্প

পর্ব -২৭

ইনায়ার নানু বাড়ির সবাই ই একে একে আনানের কাছে এসেছে। ওর অবস্থারও এখন উন্নতি ঘটেছে। তবে দেওয়ান বাড়ির কাউকেই কিছু জানানো হয়নি। নীলের কড়া আদেশ ছিল বিষয়টা নিয়ে। ইনায়াও আর সাহস করেনি তাই কাউকে জানাতে। আকবর দেওয়ান এর মাঝে কয়েকবার কল দিলে নীল জানায়,

-খুব বেশি তো আসা হয় না,আমারও ছুটি আছে। অনু আর ইনুও থাকতে চাচ্ছে। আর দুএক দিন পরে আসছি।

নীল সাধারণত বাইরে থাকতে চায় না নিজ ইচ্ছায়। আকবর দেওয়ান ছেলের এমন কথা শুনে খুশি হলেও উল্টো ভয় কাজ করতে থাকে মনে। খুব সমস্যা না হলে তো নীল বাইরে থাকার মানুষ না!

হসপিটাল থেকে জানিয়েছে আনান সম্পূর্ণ সুস্থ আছে এখন। একটু বেড রেস্টে থাকলেই হবে। যখন ইচ্ছে নিয়ে যেতে পারবে।

নীলের এখন অনেক সময় পরে চাপ মুক্ত লাগছে। হসপিটালের সব ফর্মালিটিস পূরণ করে রিফাতদের বাড়িতে চলে আসেন তারা সকলে।

.

.

নীল বাড়িতে ঢুকেই আগে ফ্রেশ হতে যায়। শরীর ভারী লাগছে তার। এদিকে ইনায়া,আনায়া ,রিফাত, সানজিদা অপেক্ষা করছে সিরিয়ালে। অন্য বাথরুমে আনান গিয়েছে,আর আরেকটাতে গিয়েছে শীলা। বাকিরা উঠানে অপেক্ষা করতে করতে এরই মাঝে শুরু হয়ে যায় ঝুম বৃষ্টি। সবাই সরে গেলেও ইনায়া সেখানেই বসে থাকে। বৃষ্টির পানি ইনায়া শরীরের সব জায়গায় ছুঁয়ে যায়। দুই হাত মেলে ইনায়া উঠে দাঁড়ালো। মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকায়। বৃষ্টির পানি চোখের কোণে জমা হলে চোখ বন্ধ করে একই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক এমন সময় নীলও বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে। পরনে কালো রঙের ভি গলার টি শার্ট আর কালো ট্রাউজার । চোখের সামনে তার ইনায়ার ভিজতে থাকার দৃশ্য। আর বারান্দায় সকলকে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য উপভোগ করতে দেখে চকিত হয় নীল। শান্ত ভাবে এগিয়ে রিফাতের হাতে টাওয়েল দিয়ে বলল,

– ওদের সবাইকে ভেতরে নিয়ে যা।

রিফাত মাথা নিচু করে সবাইকে ভেতরে যেতে বলে। আর নীল এগিয়ে যায় ইনায়ার দিকে।ইনায়ার পেছনে খুব সামান্য দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়। আশে পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ইনায়া মাথা নামায়। মুখ মুছে চোখ টিপটিপ করে তাকিয়ে পেছনে ঘুরে। নীলকে এতো কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেন হার্টবিট থেমে যায় ইনায়ার। সাথে নীলের ঘ্রাণ তাকে মাতাল করছে।কোনো রকমে বুকে হাত দিল ইনায়া। জামা হালকা করে টেনে দু তিনবার থু থু থু আওয়াজ করলো। শান্ত কন্ঠে শুধালো,

-নীল ভাই… ভিজছেন কেন?

-আপনি কেন ভিজছেন ম্যাম?

ইনায়া চমকে উঠে। বিড়বিড় করে বলে,

-ম্যাম?

নীল এবার ধমক দিয়ে বলল,

-ভিজলে যে তোর জ্বর আসে তার কি ভুলে যাস?

-এবার আসবে না…

-কেন? কোন দুঃখে?

-সুখে.. কারণ আপনি আছেন সাথে।

নীল কোনো জবাব দেয় না। কিছুক্ষণ ইনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো। এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে তারা দুজন দাঁড়িয়ে,আশে পাশে আর কেই নেই । নিজের চুল ঠিক করতে করতে নীল ইনায়ার হাতের কব্জির একটু উপরে ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে।কপালের থেকে চুল সরিয়ে বলল,

-সাদা জামা পড়ে বৃষ্টিতে ভিজতে হয় নাকি জানিস না?

ইনায়া নিজের শরীরের দিকে দ্রুত তাকায়। জামাটা একেবারে শরীরের সাথে মিশে রয়েছে। তখনই বারান্দা থেকে আনানের ডাক শুনে সেদিকে তাকায় নীল। আনান একটানা ডাকছে,

-ইনু…জ্বর আসবে! বড় ভাইয়া ওকে নিয়ে এসো।

নীল বিরক্তি নিয়ে সেদিকে তাকায়।

হাত মুঠো করে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

-এরপর থেকে বৃষ্টিতে ভিজতে হলে আগে দেখবি কী পড়ে রয়েছিস। সাথে কোথায় আছিস,তাও দেখবি।

কথা গুলো বলে আনানের থেকে তোয়ালে এনে ইনায়ার গায়ে জড়িয়ে দেয় নীল। ইনায়ার এখন লজ্জা লাগছে। আসলেই কেমন লাগছে! তোয়ালে পেঁচিয়ে দ্রুত ভেতরে চলে যায় সে।

.

.

.

.

নীল পুনরায় ভিজে চুপ চুপ অবস্থায় ঘরে ঢুকলো। বরিশালে এসে একদিন থাকার কথা ছিল। লাস্ট যেই একটা টি-শার্ট ছিল,তাও ভিজিয়ে ফেললো।

রিফাত নীলের অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে বলল,

-এখন কী করবে ভাইয়া?

-আনানের কাছে শোন তো ,ওর এক্সট্রা আছে নাকি কিছু।

-ওর কাছেও নেই। এই জন্যে বৃষ্টি তে ভিজলো না। ইনুকে দেখে ও যেতে চাচ্ছিল। পরে আবার বলল যে পড়ার মতো কিছু নেই আর।

নীলের কেমন অসহ্য রাগ হচ্ছে। বিরক্ত বোধ করে বলল,

-উফ!

-আমার একটা পান্জাবী উঠানো আছে। পার্টির থেকে দিয়েছিল,ওভার সাইজড বলে আর পড়া হয়নি। কিছু না মনে করলে তুমি পড়?

নীল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

-ঠিক আছে ,এনে দে।

রিফাত একেবারে ধবধবে সাদা একটা পান্জাবি এনে দেয় নীলের কাছে। কোনো কাজ করা নেই পান্জাবি টাতে। একেবারে প্লেইন।

নীল শরীর মুছে পান্জাবি টা পড়ে নিল। তারপর রিফাতের সামনে গিয়ে একটু ভাব নিয়ে বলল,

-কিরে নেতা নেতা লাগছে তো!

-বিশ্বাস করো ভাইয়া! তোমার চেহারা দেখে তোমাকে এমপি বানিয়ে দিবে সবাই।

-কিরে শা*লা! এই লেভেলে চাপা মারিস!

-রেসপেক্ট ব্রাদার! শালা না আমি,সমন্ধী তোমার। বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু ছোট বোনের সাথে বিয়ে ক্যানসেল করে দিব।

-ঐ সাহস নিয়ে কেউ এখনো জন্ম নেয়নি। তবে তুই সম্পর্কের দিক দিয়ে আবার আমার বড়,তাই রেসপেক্ট করলাম,যাহ্।

-সিরিয়াসলি ভাইয়া। নির্বাচনে দাঁড়াও। তোমাকে কেউ হারাতে পারবে না।

-দেখছি বিষয় টা। আজ বিকালে তোর ভার্সিটিতে নিয়ে যাবি।

-ঠিক আছে।

-বহিরাগত অ্যালাউড?

-তোমাকে দেখলে কেউ আটকানোর সাহস পাবে না। এমন বডি,চেহারার মধ্যেই ক্ষমতাবান একটা ব্যাপার আছে।

নীল হাসে। জবাবে বলে,

-তাহলে আজ বিকালে ফাইনাল।

.

.

.

.

সবাই ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে বসেছে একসাথে। শীলা, সানজিদা, সম্পূর্ণা, রিফাত,ইনায়া,আনায়া,আনান,নীল সকলেই উপস্থিত ইনায়ার নানুবাড়ির পুরান বড় টিনের ঘরটাতে। বাইরে এখনো ঝুম বৃষ্টি। অনেক মানুষ হলে,আর আড্ডা দেওয়ার সময় সকলে এই ঘরটাতেই আসে।গল্প করতে করতে শীলা প্রস্তাব রাখে কোনো একটা গেম খেলা যাক। প্রথমে ট্রুথ ডেয়ার খেলার কথা বললেও নীল রাজি না হওয়াতে গানের কলি খেলার কথা বলে।

নীলও অবশেষে বলে,

-আচ্ছা,আপু বলছো বলে… তাছাড়া গেম ভালো লাগে না…

-এতো ভয় পেলে হবে না নীল! ট্রুথ ডেয়ার টা তোলা থাকলো। খেলতে তো হবেই।

নীল মাথা ঝুঁকিয়ে হাসে। শীলা রিফাতকে বলে,

-যা তোর গিটার টা নিয়ে আয়।

রিফাত বড় বোনের কথা মতো সাথে সাথে গিটার টা এনে শীলার হাতে দিল। শীলা রিফাতের হাত থেকে নিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,

-আমি শুরু করছি,যেখানে থামবো তার পরের অক্ষর দিয়ে আমার পরের জন শুরু করবে। আর না পারলে পাস বলবে, সেক্ষেত্রে তার পয়েন্ট মাইনাস হবে।শুরু করছি,

Kabhi jo baadal barse

Main dekhoon tujhe aankhein bharke

Tu lage mujhe pahli baarish ki duaa

Tere pahloo mein reh loon

Main khudko paagal keh loon

Tu gham de ya khushiyaan

Seh loon saathiya…

যদিও গানটা আমাদের নায়কের গাওয়ার কথা ছিল । তবে সে যেমন লাজুক,আমাকেই গাইতে হলো। বৃষ্টিতে ভিজে এই গান না গাইলে প্রেম বিষয় জমে?

রিফাত কপালে হাত দিয়ে শীলার দিকে তাকায়। ওদের দুই ভাই বোনের ভাব কায়দা দেখে আনান জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

-এখানে আবার নায়ক কে?

-ও তুমি বুঝবে না। কিন্তু নায়কের উদ্দেশ্য বলছি,সে যেন লজ্জা না পায়। ভয়ও না পায়। নায়িকা কিন্তু হাতের ফাঁকা দিয়ে বেরিয়ে যাবে।

রিফাত শীলাকে থামিয়ে দেয়।বলল,

-থামো আপু! কী সব বলছো!

-দোতালায় দাঁড়িয়ে আমিও বৃষ্টি বিলাস করছিলাম ভাগ্যক্রমে। নাহলে মিস হয়ে যেত অনেক কিছু। তোরা তো আর জানাবি না কিছু! তাই এভাবেই বুঝতে হবে। কিন্তু বেশি দেরি করলে আবার ফাঁকতালে বেরিয়ে যাবে।

নীল শীলার হাত থেকে গিটার নেয়। তারে হাত রেখে বলল,

-কী অক্ষর?

সকলে জোরে চেচিয়ে বলল,

-আাাাাাাাাাা…

নীল শুরু করে,

আমার স্বপ্ন জুড়ে তুই, আর তোর চিন্তারা শুধুই

ঘুরে ফিরে যাচ্ছে বারেবার

আর কোনো রাস্তা নেই আমার

বলনা তোর দোহাই প্রেম ভাসাই কোন জলে…

O My Love……. আদুরে আলাপ…..

ছুঁয়ে তোরই আঁচলে এলাম বলে

Be My Love …..একটা গোলাপ….

চুপিসারে রেখে গেলাম তোর কোলে

গান শেষ করে শীলার দিকে তাকিয়ে বলল,

-আপু সেই নায়ক নিশ্চয়ই হাত মুঠো করে রেখেছে। যাতে তার নায়িকা চাইলেও বেরিয়ে যেতে না পারে।

নীলের গাওয়া গান শুনে ইনায়া মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে। আস্তে আস্তে আনায়াকে ডেকে বলল,

-তুই জানতি অনু?

-কী?

-নীল ভাই এতো সুন্দর গান গায়।

আনায়া মাথা ঘুরিয়ে ইনায়ার দিকে তাকায়। হতাশ কন্ঠে বলে,

-এমন পা*গলামি করে কথা বলো মাঝে মাঝে,আমার হাসি পায়।

ইনায়া মুখ ভার করে আনায়াকে দেখে

.

.

.

.

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে নীল আর রিফাত।

রিফাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই নীলকে বলল,

-ভাই তুমি দেখতে থাকো,আমি একটু কথা বলে আসি ওদের সাথে।সেদিনের ঝামেলা নিয়ে।

-কী বলবি?

-কেন এমন করলো তাই। বড় ভাইদের ডেকেছি।

-চল আমিও যাব।

রিফাত আর নীলকে মানা করে না। সাথে করে নিয়ে যায় তাকে। রিফাতের পেছনে নীল প্রবেশ করতেই সিনিয়র জুনিয়র সকলে উঠে দাঁড়ায়। রিফাত হকচকিয়ে যায় এমন ঘটনায়। সাথে সাথে হাতে ইশারায় সবাইকে বসতে বলল সে। পরক্ষনেই বুঝতে পারে আসলে সবাই নীলের জন্য দাঁড়িয়েছে। রিফাত এক দৃষ্টিতে হা করে নীলের দিকে তাকিয়ে থাকে। নীল সেদিকে না দেখে রিফাতের কাঁধে হাত দিয়ে বলে,

-চল বসি।

নীল আর রিফাত গিয়ে দুটো চেয়ার নিয়ে বসে। রিফাতদের ইমিডিয়েট সিনিয়র পা নীলকে বলতে শুরু করল,

-ভাই আপনি আসতে গেলেন কেন এতো কষ্ট করে?

আমরাই সব মিটমাট করতাম।

-নিজের হাতে না করলে আসলে শান্তি লাগবে না।

-ভাই ছেলেগুলোর দিকে তাকান, দাঁত ভেঙে ফেলছি মা*রতে মা*রতে। আরান ভাই কল দিয়ে জানানোর পরপরই সব ব্যবস্থা নিয়েছি। আর মা*রলে ম*রে যাবে।

নীল উঠে দাঁড়ালো।

কোনায় থাকা বড় একটা টুকরো রড হাতে তুলে ঐ ছেলেদের দিকে এগিয়ে যায় নীল। বাম হাতে রড ধরে,ডান হাতের ঘড়ি উপরে তুলে নেয়। জোড়ে জোড়ে বলতে থাকে,

-যে জিনিসে নজর দিয়েছে,ওদের নিজের হাতে র*ক্তাক্ত না করলে আমি শান্তি পাবো না।

কথাটা বলেই নীল এলোমেলো ভাবে শক্ত হাতে মারতে থাকে ওদের। হাতের পাশাপাশি পা দিয়েও মারে। বেশ অনেক্ষণ ধরে মা*রার পরে রড ফেলে দেয় নীল। ওদের থেকে কয়েক হাত দূরে গিয়ে বলল,

-এই সাদা পাঞ্জাবি তে দাগ লাগলে আমার ইনু ভয় পাবে। তাই তোদের ছেড়ে দিচ্ছি এবারের মতো।

রিফাত নীলকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। ক্যাম্পাস ছাড়তেই নীলকে সালাম করে রিফাত,

-আসসালামু আলাইকুম ভাই!

-ঢং করছিস কেন?

-ওদের কে তো ছেড়ে দিয়ে খুব উপকার করলেন। মিনিট দশেক এর মধ্যে হসপিটালে না নিলে একটাও বাঁচবে না।

-জানি।

-কাদেরকে বললে তাহলে যে এবারের মতো ছেড়ে দিলাম? একটারও তো হুশ নেই।

-ওটা মনের সান্তনা ছিল।

-তোমাকে আমার সালাম ভাই!

রিফাত স্যালুট করে নীলের সামনে দাঁড়িয়ে রইল।

পেইজ: সবার আগে গল্প পাওয়ার জন্য রোমান্টিক প্রেমের গল্প পেইজটি নীল লেখায় চাপ দিয়ে ফলো করে রাখবেন

(চলবে……)

আমাদের সিরাজগঞ্জ এর সর্বশেষ আপডেট পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

আরও পড়ুন

Back to top button

Please Disable "ADBLOCKER"

আপনাদের জন্য কত কষ্ট করছি আর আপনারা "ADBLOCKER" ব্যবহার করছেন ? আমাদের ইনকাম নেই বললেই চলে, দয়া করে "ADBLOCKER" টা বন্ধ করে সাহায্য করবেন । Please Disable "ADBLOCKER", Its Help us to Add More Content Like This, Thanks.